ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী টাটা সান্স-এর চেয়ারম্যান ইমিরেটাস রতন টাটা ৮৬ বছর বয়সে মারা গেছেন। বুধবার (১০ অক্টোবর) রাতে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
গত কয়েকদিন ধরেই এই শিল্পপতি চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। সোমবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে তিনি জানিয়েছিলেন, বয়সজনিত কারণে তিনি রুটিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাচ্ছেন।
এক বিবৃতিতে টাটা সান্সের চেয়ারম্যান এন চন্দ্রশেখরন রতন টাটার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বিবৃতিতে টাটা সান্সের চেয়ারম্যান বলেন, গভীর শোকের সঙ্গে আমরা রতন নাভাল টাটাকে বিদায় জানাচ্ছি।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, টাটা গ্রুপের কাছে মি. টাটা শুধু একজন চেয়ারম্যানই ছিলেন না। আমার জন্য তিনি ছিলেন মেন্টর, পথপ্রদর্শক এবং বন্ধু। তিনি নজির তৈরির মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করতেন। উৎকর্ষতা, সততা এবং উদ্ভাবনের প্রতি অটল প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে টাটা গ্রুপ তার নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করেছে।
সমাজসেবায় রতন টাটার অবদানের কথা স্মরণ করে চন্দ্রশেখরন বলেন, শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্যসেবা পর্যন্ত তার উদ্যোগগুলো গভীর প্রভাব ফেলেছে, আগামী প্রজন্মও যার সুফল পাবে।
এদিকে রতন টাতার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বুধবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রতন টাটার সঙ্গে কয়েকটি ছবি পোস্ট করে তিনি লিখেছেন, শ্রী রতন টাটাজি একজন দূরদর্শী শিল্পপতি ছিলেন। তার মনটা মমতায় পরিপূর্ণ ছিল। মানুষ হিসেবে অসাধারণ ছিলেন। তিনি ভারতের অন্যতম পুরনো এবং অন্যতম সেরা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
রতন টাটা ১৯৯১ সালে ১০০ বিলিয়ন ডলার বাজারমূল্যের শিল্পগোষ্ঠী টাটার চেয়ারম্যান হন। ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রপিতামহের প্রতিষ্ঠিত এই গ্রুপ পরিচালনা করেন তিনি।
দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই টাটা গ্রুপের কিছু কোম্পানির প্রধানদের ক্ষমতায় রাশ টানার উদ্যোগ নেন রতন টাটা। অবসরের বয়সসীমা নির্ধারণ করেন, তরুণদের উচ্চপদে বসান। এছাড়া কোম্পানিগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নেন তিনি।
তিনি ১৯৯৬ সালে টেলিযোগাযোগ সংস্থা টাটা টেলিসার্ভিসেস প্রতিষ্ঠা করেন, ২০০৪ সালে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেসকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করেন।
রতন টাটার নেতৃত্বে টাটা গ্রুপ আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক অঙ্গনে উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত হয়। তার নেতৃত্বে শিল্পগোষ্ঠীটি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড অধিগ্রহণ করে। বিশেষত তার নেতৃত্বে ন্যাশনাল রেডিও অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স কোম্পানি সংকটময় অবস্থান থেকে ঘুরে দাঁড়ায়।
রতন টাটার নেতৃত্বেই টাটা গ্রুপ ২০০০ সালে ব্রিটিশ চা কোম্পানি টেটলি, ২০০৭ সালে কোরাস স্টিল রোভার অধিগ্রহণ করে। টাটা গ্রুপ ২০০৮ সালে আইকনিক ব্রিটিশ গাড়ির ব্র্যান্ড জাগুয়ার ও ল্যান্ড রোভারও অধিগ্রহণ করে তার নেতৃত্বেই।
২০০৯ সালে রতন টাটা বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা গাড়ি মধ্যবিত্তের নাগালে পৌঁছে দেন। ১ লাখ রুপি মূল্যের টাটা ন্যানো জনপ্রিয়তা পায়।
এছাড়া টাটা মোটরসে তার আরেকটি পছন্দের প্রকল্প ছিল ইন্ডিকা। এটি ভারতের প্রথম স্থানীয়ভাবে নকশা ও উৎপাদন করা গাড়ি মডেল। রতন টাটার ইন্ডিকা প্রকল্প দারুণ সাফল্য পায়। তবে ন্যানো প্রাথমিক নিরাপত্তয়া সমস্যা ও বিপণনের ব্যর্থতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাজারে আসার এক দশক পর টাটা ন্যানোর উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়।
১৯৯১ থেকে ২০১২ এবং ২০১৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দুবার টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন রতন টাটা। কোম্পানিটির দৈনন্দিন কার্যক্রম থেকে সরে দাঁড়ালেও তিনি এর দাতব্য ট্রাস্টগুলোর নেতৃত্বে ছিলেন।
অবসর গ্রহণের পর টাটা সান্স, টাটা ইন্ডাস্ট্রিজ, টাটা মোটরস, টাটা স্টিল ও টাটা কেমিক্যালসের চেয়ারম্যান ইমেরিটাস হন রতন টাটা।
রতন টাটার জন্ম ১৯৩৭ সালে। ১৯৪৮ সালে তার বাবা-মা আলাদা হয়ে যাওয়ার পর তিনি দাদি নবজাবাই টাটার কাছেই বড় হন। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য নিয়ে পড়াশোনার পর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট কোর্স করেন রতন টাটা।
১৯৬২ সালে তিনি টাটা গ্রুপের প্রোমোটার কোম্পানি টাটা ইন্ডাস্ট্রিজে সহকারী হিসেবে যোগ দেন এবং জামশেদপুরের একটি কোম্পানি প্ল্যান্টে ছয় মাস প্রশিক্ষণ নেন।
এরপর তিনি টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি (এখন টাটা স্টিল), টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস (টিসিএস) ও ন্যাশনাল রেডিও অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স-এ কাজ করতে আরম্ভ করেন।
১৯৯১ সালে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে টাটা গ্রুপের নেতৃত্ব দেওয়া জেআরডি টাটা তার উত্তরসূরি হিসেবে রতন টাটাকে নির্বাচিত করেন।
রতন টাটা চিরকুমার ছিলেন। তবে এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেছিলেন, তার জীবনে প্রেম এসেছিল। চার-চারবার বিয়ের পিঁড়িতে বসার উপক্রম হলেও শেষ পর্যন্ত সেগুলো আর পরিণতি পায়নি।
রতন টাটা একবার স্বীকার করেছিলেন, লস অ্যাঞ্জেলেসে কাজ করার সময় তিনি প্রেমে পড়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধ বাধায় মেয়েটির বাবা-মা তাকে ভারতে আসতে দেননি।
২০০৮ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মবিভূষণে ভূষিত হন এই শিল্পপতি। এর আগে ২০০০ সালে তৃতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা পদ্মভূষণে ভূষিত হন।
ব্যবসায়িক সাফল্যের বাইরেও রতন টাটা উদ্যোক্তাদের সমর্থন দেয়ার জন্য সুপরিচিত ছিলেন রতন টাটা। তিনি বিভিন্ন খাতে ৩০টিরও বেশি স্টার্ট-আপে বিনিয়োগ করেছিলেন। এর সুবাদে তিনি ভারতের স্টার্ট-আপ ইকোসিস্টেমের বিশিষ্ট বিনিয়োগকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।