দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন: ১৭ ও ১৮ তারিখ ঘিরে গুঞ্জন

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন রোববার (১৭ ডিসেম্বর)। এরপর ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ। মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন ও পরদিন প্রতীক বরাদ্ধকে কেন্দ্র করে নানা গুঞ্জন চলছে রাজনীতিতে। শেষ মুহুর্তে জাতীয় পার্টি মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায় নাকি আসন সমঝোতার ভিত্তিতে অংশ নেয় এ নিয়ে কৌতূহল বাড়ছে।

অপরদিকে ১৪ দলের শরিক দল গণতন্ত্রী পার্টির সব প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে দ্বন্দ্বের কারণে এ সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও শেষ মুহুর্তে নির্বাচনে অংশ নেবে কী না এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্ধে জাকের পার্টি।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) চেয়ারম্যান শাহ্‌ মো. আবু জাফর বলেছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে, এমন আশ্বাসে তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এরপরও যদি দেখেন নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হচ্ছে না বা নির্বাচনের পরিবেশ নেই, তাহলে বিএনএম নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবে।

জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত দলের মনোনীত প্রার্থীদের লাঙল প্রতীকের চিঠি দেয়নি। দলের প্রতীকের চিঠি না পাওয়া ও আসন সমঝোতা নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে চূড়ান্ত সমঝোতা না হওয়ায় নির্বাচন প্রশ্নে উদ্বেগে আছেন দলটির সংসদ সদস্য ও নতুন প্রার্থীরা। শেষ মুহূর্তে চূড়ান্ত সমঝোতা না হলে নির্বাচন বর্জনের কথা ভাবছে দলটি।

জাতীয় পার্টির দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণ কিংবা বর্জনের একক সিদ্ধান্ত নেবেন জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের। এ লক্ষ্যে গত ৫ নভেম্বর দলের এক মিটিংয়ে সর্বসম্মতভাবে চেয়ারম্যানকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়। আসন সমঝোতা না হলে জাপা নির্বাচনে অংশ নেবে না এরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন জি এম কাদের। ফলে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হলেও জাপার দলীয় প্রতীকের চিঠি কাউকে দেওয়া হয়নি। কারণ শেষ মুহুর্তে জি এম কাদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে চাইলেও অনেকেই বেঁকে বসতে পারেন।

এক্ষেত্রে ২০১৪ সালের নির্বাচনে দলটির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের মতো ভুল করতে চান না ভাই জি এম কাদের। ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে শেষ মুহুর্তে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে সরে যেতে চান এরশাদ। এ জন্য তিনি নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েও তার সিদ্ধান্তের কথা জানান। একইসাথে জাপার মনোনয়ন প্রাপ্ত সব প্রার্থীকে প্রার্থীকের চিঠি ফিরিয়ে দিতে ও মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বলেছিলেন। তার নির্দেশে জি এম কাদেরসহ আরও অনেকেই মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেও রওশন এরশাদের নেতৃত্বে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নেন জাপার একটা বড় অংশ। এরশাদকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করে রাখা হয় এবং দৃশ্যপটে রাখা হয় স্ত্রী রওশনকে। হাসপাতালে থাকা এরশাদ রংপুর-৩ আসন থেকে জিতে সংসদে আসেন। যদিও তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আগেই জানিয়েছিলেন।

২০১৪ সালের ন্যায় এবারও আরেকটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোকে ছাড়া। ফলে এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশ নেওয়া না নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে চান চেয়ারম্যান জি এম কাদের এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। ইতোমধ্যে শাসকদল আওয়ামী লীগ থেকে ২৩-২৬ আসন জাপাকে ছাড় দিয়ে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা জানিয়েছে। কিন্ত এসব আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা থাকবেন বলে জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্ররা প্রার্থীরা থাকলে জাপার আসন হারানো নিশ্চিত।

এদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকলে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টি দীর্ঘদিনের মিত্র। যাদেরকে এতদিন বন্ধু হিসেবে মনে করেছি নির্বাচনের মাঠে হঠাৎ করে তাদের শত্রু বানাতে পারব না। আমার এই সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে নেওয়া নয়। আমি আমার দলের শীর্ষ নেতাদের আগেই জানিয়েছিলাম নৌকার প্রার্থী মাঠে থাকলে আমি নির্বাচনে অংশ নিতে চাই না।

কেবল কাজী ফিরোজ নয়, এবার আওয়ামী লীগ থেকে আসন সমঝোতার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সেই তালিকায় জাপার দুই প্রভাবশালী কো চেয়ারম্যন রুহুল আমীন হাওলাদার ও সালমা ইসলামকে রাখা হয়নি। আরেক কো চেয়ারম্যান আবু হোসেন বাবলার আসন নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। কাজী ফিরোজ রশীদ ছাড় না পাওয়ার খবর শুনে আগেই নৌকা থাকলে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কো চেয়ারম্যানদের মধ্যে কেবল আনিসুল ইসলাম মাহমুদের আসন নিশ্চিত হয়েছে।

অপরদিকে আওয়ামী লীগ ছাড় দিলেও তাদের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেও জিতে আসার সম্ভাবনা কম জাপার। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে মহাজোট গঠন করে ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ। সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে ২৯টি আসনে ছাড় দেয় আওয়ামী লীগ, যেখানে তাদের কোনো প্রার্থী ছিল না।

একই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি প্রার্থী দেয় এমন ২০টি আসনের একটিতেও জয় পায়নি জাতীয় পার্টি। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এবারের মতো নির্বাচন বর্জন করেছিল। ওই নির্বাচনে জাপার অংশগ্রহণ নিয়েও নানা প্রশ্ন ছিল। সেই নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত জাপার অংশগ্রহণ আওয়ামী লীগকে বড় স্বস্তি দিয়েছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে ৩৩টি আসনে জয় পেয়েছিল জাপা। কিন্তু একই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাপা প্রার্থী দিয়েছিল এমন ৫৫টি আসনের মধ্যে ৪৬টিতেই হেরেছিল দলটি।

জানিপপ চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ১৭ ও ১৮ তারিখ ঘিরে এখনও যথেষ্ট গুঞ্জন রয়েছে। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ কিংবা বর্জন কোনোটাই নিশ্চিত নয়। একইভাবে বনিবনা না হলে আরও কয়েকটি দলও যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ১৪ সালের ঘটনা থেকে জি এম কাদের প্রতীক হাতে রাখার যে কৌশল নিয়েছেন এটা দর কষাকষির মাঠে অধিক সুবিধা দেবে।

গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, শুনানির জন্য ১৫ দিনের সময় দিয়েছেন নির্বাচন কমিশন। আমরা শুনানি করতে ইচ্ছুক। যেহেতু এই ১৫ দিন সময়ের মধ্যে প্রতীক বরাদ্ধ হয়ে যাবে, তাই নির্বাচনে গণতন্ত্রী পার্টির যেসব প্রার্থীর মনোনয়ন রিটার্নিং অফিসার বাছাই করে বৈধ ঘোষণা করে প্রতীক বরাদ্ধের জন্য পত্র দেয়া হয়েছে, সেসব বৈধ প্রার্থীদের প্রার্থিতা বহাল রেখে প্রতীক বরাদ্ধ করে নির্বাচনে গণতন্ত্রী পার্টিকে অংশগ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছি ইসিকে। এখন নির্বাচনে অংশগ্রহণ নির্ভর করছে পুরোপুরি ইসির ওপর।

২১৮টি আসনে এবার প্রার্থী দিলেও ১০ জন বাছাইয়ে বাদ পড়েছেন জাকের পার্টির। তবে দলটি এখনও নির্বাচনে অংশ নেবে কী না সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করা এই দলটি জানিয়েছে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত পরিস্থিতি দেখে তারা সিদ্ধান্ত নেবে।

জাকের পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার বলেন, এবারের নির্বাচনে ভালো কিছুর প্রত্যাশা করছি। নির্বাচনকে লক্ষ্য করে প্রতিটি আসনে আলাদা করে প্রার্থী বাছাই ও ভোটের মাঠ তৈরিতে ৮ মাস ধরে প্রস্তুতি নিয়েছি। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হলে ভোট থেকে বিরত থাকব আর যদি দল মনে করে পরিবেশ সুষ্ঠু থাকবে তাহলে নির্বাচনে অংশ নেব।

এসআই/আজকের বেলা
আজকের বেলাইসিনির্বাচন
Comments (০)
Add Comment