চট্টগ্রামের আদালতগুলোতে যাচ্ছেন না সরকারি পিপি, জিপি ও এপিপিরা। এতে সাক্ষ্যগ্রহণ থেকে শুরু করে যুক্তিতর্ক, এমনকি রায় প্রদানের কার্যক্রম কোনোটা ঠিকমতো চলছে না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদেরকে ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে আদালতের কার্যক্রম।
এদিকে সরকারি আইনজীবীরা দায়িত্ব পালন না করায় বিচার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে জানিয়ে সচেতন আইনজীবীরা বলেন, নতুন পিপি, জিপি ও এপিপি নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত এ সংকট থাকবে। এ জন্য দ্রুত নতুন সরকারি আইনজীবী নিয়োগ করে বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, জেলা পিপি সরকার পতনের পর থেকে আদালতে যাননি। তার অধীন অন্যান্য এপিপিরাও দায়িত্ব পালনে বিরত আছেন। মহানগর পিপি মাঝেমধ্যে গেলেও আগের মতো কাজ করছেন না। পিপির যে দায়িত্ব তা পালনে তিনি বিরত আছেন। তার অধীনে থাকা অন্যান্য আদালতগুলোতে থাকা বেশিরভাগ এপিপিরও অবস্থা একই।
এছাড়া সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনাল, জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনাল, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল, নারী শিশু ট্রাইব্যুনালসহ অন্যান্য ট্রাইব্যুনালগুলোর পিপিরা নিয়মিত চেম্বার করলেও স্ব স্ব আদালতে তাদের দেখা যাচ্ছে না। ব্যতিক্রম শুধু দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত। এ আদালতে থাকা দুদকের তিনজন আইনজীবী নিয়মিত মামলা পরিচালনা করছেন। তবে আদালতটিতে থাকা অন্যান্য মামলা পরিচালনায় যিনি নিয়োজিত তিনি (কামরুন নাহার বেগম) অনুপস্থিত। তিনিও সরকার পতন পরবর্তী আদালতে হাজির হয়ে দায়িত্ব পালনে বিরত আছেন।
আইনজীবীরা বলছেন, সরকারি আইনজীবীদের অনুপস্থিতিতে বিশেষ করে ফৌজদারি মামলার বিচার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ধরনের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন এমনটা দাঁড়িয়েছে যে, রাষ্ট্রপক্ষে কথা বলার মতো কেউ নেই। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা।
আদালত সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত সরকারের আমলে চট্টগ্রামের আদালতগুলোতে নিয়োগ পাওয়া আইনজীবীর সংখ্যা প্রায় ৫০০। দলীয় বিবেচনায় তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। সরকার পতনের পর তাদের অনেকে স্বেচ্ছায় আদালতে যাচ্ছেন না। আবার অনেকে গেলেও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন।
সরকারি আইনজীবীদের অনেকেই বলছেন, আইনজীবীদের একটি পক্ষ আদালতে গিয়ে পেশকার, পিয়নদের বলেছেন পিপি, এপিপিদের যাতে সহযোগিতা না করেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বেঞ্চ সহকারী আব্বাস হোসেন বলেন, আমাদের ট্রাইব্যুনালের পিপি হচ্ছেন নিখিল কুমার নাথ। সরকার পতন পরবর্তী তিনি ট্রাইব্যুনালে অনুপস্থিত। এতে বিচার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই।
সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালের বেঞ্চ সহকারী মো. বরাত বলেন, আমাদের পিপি রুবেল পাল। বর্তমানে তিনি আসছেন না। আমরা তো কাউকে জোর করে আনতে পারি না। রুবেল পাল জানান, গত সপ্তাহে তিনি একদিন কোর্ট করেছেন।
জেলা আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আজহারুল হক বলেন, এখন ভিন্ন পরিস্থিতি। এ জন্য এপিপির দায়িত্ব পালন করছি না। নতুনরা দায়িত্ব নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
বিএনপিপন্থী আইনজীবী মো. রেজাউল করিম রনি বলেন, ‘বর্তমানে যারা পিপি, জিপি ও এপিপি আছেন তারা সকলে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন। তারা শেখ হাসিনার অনুসারী। এর মধ্যে ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছেন। এ অবস্থায় তার অনুসারীরা কিভাবে এখানে দায়িত্ব পালন করবেন? তারা নিজেরাও বিষয়টি বুঝতে পারছেন। হাসিনার ওপর ক্ষিপ্ত অনেকে তাদেরকে ডিস্টার্ব করছেন। তাদের আসলে পদত্যাগ করা উচিত ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও তাদের নিয়োগ বাতিল করেনি।
এ অবস্থায় একটা সংকট সৃষ্টি হয়েছে। নতুন নিয়োগ হলে সংকট কেটে যাবে। তিনি বলেন, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম চট্টগ্রাম শাখা থেকে কেন্দ্রীয় ফোরামে একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। সেটি আইন মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার কথা। তবে বর্তমানে কী অবস্থা জানি না। আমরা চাই, যোগ্য ও মেধাবীরা সরকারি আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ পাক।’
জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগকৃত পিপি, জিপি ও এপিপিরা হতাশ। এ জন্য তারা আদালতে গিয়ে মামলা পরিচালনা করছেন না। এতে অবশ্যই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফৌজদারি মামলার বিচারে অবশ্যই সরকারি আইনজীবী প্রয়োজন হয়। বর্তমান আইন উপদেষ্টার কাছে আরজি হচ্ছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে যোগ্য ও মেধাবীদের মধ্য থেকে সরকারি আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হোক। আমরা সমিতির পক্ষ থেকে নানা ফোরামে বিষয়টি জানিয়েছি।