‘ইয়া আল্লাহ পুরি ইনসানিয়াত কো হেফাজত ফরমা, ইয়া আল্লাহ পুরি উম্মত পর রহম ফরমা, ইয়া আল্লাহ তু হামপর রাজি হো যা, ইয়া আল্লাহ হামারে দিলকো ইসলাম পর কবুল ফরমা, ইয়া আল্লাহ ছব লোক কো হেদায়াত নসিব ফরমা, ইয়া আল্লাহ পেরেশানি কো দূর ফরমা, ইয়া আল্লাহ ইজতেমাকো কবুল ফরমা, ইয়া আল্লাহ ছব লোক কো মোনাজাত কবুল ফরমা।’
এসব গভীর আকুতি মিনতি, নিজেকে আত্মসমর্পণ ও অশ্রুসিক্ত আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে দিল্লি নিজামউদ্দিন মারকাজের তত্ত্বাবধানে আজ রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) শেষ হলো মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় মিলনমেলা, বিশ্ব তাবলিগ জামাত বিশ্ব ইজতেমার ৫৭তম আসর।
লাখো মানুষের কাঙ্ক্ষিত আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন বিশ্ব তাবলীগ জামায়াতের দিল্লী মারকাজের শীর্ষস্থানীয় আলেমে দ্বীন মাওলানা সা’দ আহমদ কান্ধলভী’র বড় ছেলে ইউসুফ বিন সা’দ কান্ধলভী। সকাল থেকে দিক নির্দেশনামূলক বয়ানের পর লাখো মানুষের প্রতীক্ষার অবসান ঘটে বেলা ১১টা ১৭ মিনিটে।
বেলা ১১ টা ১৭ মিনিট থেকে শুরু করে ১১টা ৪৩মিনিট পর্যন্ত ২৬ মিনিট মোনাজাত হয়। ২৬ মিনিট স্থায়ী অগনিত জনসমূদ্রে হঠাৎ নেমে আসে পিনপতন নিরবতা। যে যেখানে ছিলেন সেখানে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে হাত তুলেন আল্লাহর দরবারে। আখেরি মোনাজাতকে ঘিরে লাখ লাখ মুসলমান যেন ভেঙে পড়েছিলেন টঙ্গীতে।
সকল পথের মোহনা হয়ে উঠে তুরাগ তীরের ইজতেমা ময়দান। টঙ্গী, গাজীপুর, উত্তরাসহ চারপাশের এলাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, মার্কেট, বিপনীবিতান, অফিসসহ প্রায় সব কিছু ছিল বন্ধ। সকলের প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিল দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লিদের সাথে মোনাজাতে শরীক হয়ে নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। ২৬ মিনিটের মোনাজাতে মূলত প্রথম পবিত্র কোরআনে বর্ণিত দোয়ার আয়াতগুলো উচ্চারণ মাধ্যমে ও পরে উর্দু ভাষায় দোয়া করেন।
মোনাজাতে সমগ্র বিশ্বের পথভ্রষ্ট মুসলমানদের নাজাত, ঐক্য, মুক্তি, সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা, আত্মশুদ্ধি, ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ কামনা করে রাব্বুল আলামীনের দরবারে হাজির ফরিয়াদ জানানো হয়। ভাবাবেগপূর্ণ পরিবেশে ‘আমীন, আল্লাহুম্মা আমীন’ ধ্বনিতে শীতের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে মহামহিম ও দয়াময় আল্লাহর দরবারে অপার করুনা ও অশেষ রহমত কামনা করেছেন দেশ-বিদেশের প্রায় ২০ লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান।
আবেগঘন আখেরি মোনাজাতে লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে রাহমানুর রাহীম অসীম, অনন্ত, প্রেমময় আল্লাহুর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। সকলেই যেন কিছু সময়ের জন্য আল্লাহর প্রেমে দিওয়ানা হয়ে ভুলে গিয়েছিল হিংসা-বিদ্বেষ, ক্ষোভ ও ভেদাভেদ। আমীর-ফকির, মনীব-ভৃত্য, ধনী-গরীর, নেতা-কর্মী নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ পরওয়ারদেগার আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য নি:শর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।
বিশাল জনসমুদ্র থেকে আকাশ কাপিয়ে ধ্বনি উঠে-‘ইয়া আল্লাহ, ইয়া আল্লাহ’। মুঠোফোনে এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সুবাধে দেশ-বিদেশের আরো লাখ লাখ মানুষ এক সঙ্গে হাত তুলেছেন ক্ষমাশীল পরওয়ারদিগারের শাহী দরবারে। গুনাহগার, পাপী-তাপী বান্দা প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা চেয়ে কান্নায় চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছেন।
বয়ান করলেন যাঁরা
গতকাল ফজরের পরে বয়ান করেন মাওলানা সাঈদ বিন সাদ (ভারত), বাংলায় অনুবাদ করেন মুফতি ওসামা ইসলাম। সকাল সাড়ে ১০টায় তালিমের বয়ান করেন মাওলানা আব্দুল আজিম (ভারত)। জোহরের পরে বয়ান করেন মাওলানা শরিফ (ভারত), বাংলায় তরজমা করেন মাওলানা মাহমুদুল্লাহ। আসরের পরে বয়ান করেন মাওলানা ওসমান (পাকিস্তান), বাংলায় তরজমা করেন মাওলানা আজিম উদ্দিন। মাগরিবের পর বয়ান করেন মুফতি ইয়াকুব (ভারত), বাংলায় তরজমা করেন মাওলানা মনির বিন ইউসুফ।
আজ রবিবার ফজরের পর বয়ান করেন মুফতি মাকসুদ (ভারত), বাংলায় তরজমা করবেন মাওলানা আব্দুল্লাহ। সকাল ১০টার দিকে হেদায়েতের বয়ান করেন মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ (ভারত), বাংলায় তরজমা করবেন মাওলানা মনির বিন ইউসুফ। এরপর আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।
ভিআইপিদের মোনাজাতে অংশগ্রহণ
দ্বিতীয় পর্বের আখেরী মোনাজাতে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে মোনাজাতে অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি এ্যাড. আজমত উল্লা খান, সাবেক সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মাহবুব আলমসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ।
আট মুসল্লির মৃত্যু
বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে আজ পর্যন্ত আট মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ইজতেমা ময়দানে সাতজন ও ময়দানে আসার পথে একজনের মৃত্যু হয়। তাঁরা হলেন ঢাকার বংশালের মুনতাজ উদ্দিন (৭৮), সিরাজগঞ্জের কাজিপুরের জালাল মণ্ডল (৬০), জামালপুরের ইসলামপুরের নবীর উদ্দিন (৬০), শেরপুরের আবুল কালাম (৬৫), নেত্রকোনার কেন্দুয়ার আব্দুল হেলিম মিয়া (৬২), দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের জহির উদ্দিন (৭০) ও লক্ষ্মীপুরের রামগতির আবুল কাসেম (৬৫)। ইজতেমায় আসার পথে আবদুল্লাহপুরে বাসের ধাক্কায় আবুল কাসেম মারা যান। সর্বশেষ মৃত ব্যাক্তি যশোর জেলার ঝিকরগাছা থানার চারাতোলা গ্রামের মৃত কাবিল হোসেনের ছেলে হারন অর রশীদ(৬৫)। আজ রবিবার ভোররাত ৩ টার দিকে ইজতেমা ময়দানে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান।
৬৫ দেশের ৯২৩১ জন বিদেশি মেহমান
আজ রোববার সকাল ১০ টায় বিশ্ব ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়কারী মোহাম্মদ সায়েম জানান, এই পর্যন্ত ৬৫টি দেশের ৯২৩১ জন বিদেশি মেহমান ইজতেমা ময়দানে এসেছেন। এর মধ্যে ইংলিশ ২৬১৫, পশ্চিমবঙ্গ ২৭৫৯, উর্দু ২৬৬২, আরব ৭৩২ জন, বিদেশী শিক্ষার্থী ১৯০, এক্সপেট্রিয়েট ( বিদেশে বসবাসের উদ্দেশ্য নিজ দেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করা) ২৭৩।
দেশগুলো হল, ভারত, আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন, ব্রুনাই, কানাডা, চীন, ক্যামেরুন, কঙ্গো, মিশর, ফিজি, ফ্রান্স, ঘানা, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ইসরাইল, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, জাপান, জর্ডান, কাজাখিস্তান, কেনিয়া, কুয়েত, কিরগিজিস্তান, লেবানন, মালয়েশিয়া, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, মিয়ানমার, নেপাল, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, কাতার, রাশিয়া, সৌদি আরব, সেনেগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলংকা, সুইজারল্যান্ড, সুদান, সুইডেন, তানজানিয়া, থাইল্যান্ড, উগান্ডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, ভিয়েতনাম ও ইয়েমেন সহ ৬৫টি দেশ।
যৌতুক বিহীন ১৪ টি বিয়ে
গতকাল শনিবার বাদ আসর ইজতেমা ময়দানে যৌতুক বিহীন ১৪ জোড়া বিয়ে হয়। বিয়ের বর কনেরা হলেন, হোমায়ার ইসলাম- হুরাইরা জামান, মো. আলাউদ্দিন- সুমাইয়া ইসলাম, মো. হাবিবুর রহমান- মুক্তা আক্তার, মো. ওমর- ইশরাত জাহান, সুজন আহমেদ- মায়মুনা আক্তার, রাতুল- মায়মুনা আক্তার, ওমায়ের ইসলাম- মুনিম আক্তার, মো. শাওন- ছবিনা আক্তার, মো. মছুরুল হক- শাদিয়া মাহমুদ, ফজলে রাব্বি- মোহনা সুলতানা মো. ছাব্বির হাসান- মোছাম্মদ হালিমা আক্তার, মো. ইজমাইন- ফাতেমা আক্তার ও মো. আজম খান- সুমাইয়া ইসলাম।
বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের মিডিয়া সমন্বয়কারী মোহাম্মদ সায়েম এই বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ৫৭ তম বিশ্ব ইজতেমায় প্রথম পর্বে ৭২ জোড়া ও দ্বিতীয় পর্বে ১৪ জোড়াসহ মোট ৮৬ জেড়া যৌতুক বিহীন বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।
এদিকে ইজতেমা ময়দানের চারিদিকে বিভিন্ন অলিগলিতে রাস্তায় বসে নারীদেরকেও মোনাজাতে শরীক হতে দেখা গেছে। মোনাজাতে শরীক হতে বাদ পড়েনি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পুরুষ ও নারী সদস্যও। বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরাঁয় যারা বসা ছিলেন তারাও যার যার জায়গা থেকে মোনাজাতে শরীক হন।
উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সাল থেকে বিশ্ব ইজতেমা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে টঙ্গীতে। ১৯৯৬ সালে একই বছর দুবার বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। স্থান সংকুলান না হওয়ায় এবং মুসল্লিদের চাপ ও দুর্ভোগ কমাতে ২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে ইজতেমা আয়োজন করা হচ্ছে। এবার ৫৭তম ইজতেমার দু’পর্বে বিদেশী রাষ্ট্রের প্রায় ১৮ হাজার বিদেশী মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন। প্রথম পর্বে ২৬ জন ও দ্বিতীয় পর্বে আটজনসহ ৫৭ তম বিশ্ব ইজতেমায় মোট ৩৪ জন মারা গেছেন।