চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) আয়োজিত বইমেলার নাম ‘চট্টগ্রাম বইমেলা’ করে তা আন্তর্জাতিকীকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিকীকরণে কলকাতা, আগরতলা, আসামসহ অন্যান্য বাংলা ভাষাভাষী গুণীজনদের সম্মানিত করার পাশাপাশি সেখানকার প্রকাশকদের চট্টগ্রাম বইমেলায় আমন্ত্রণ জানাতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
এ বিষয়ে চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম সবসময় এগিয়ে থাকে। চট্টগ্রাম সবসময় পথ দেখায়। আজ যে প্রস্তাব এসেছে আমরা গ্রহণ করলাম। চট্টগ্রামের কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ সবাইকে নিয়ে বসে ইনশাল্লাহ সিদ্ধান্ত নেব, আগামী বছর চট্টগ্রাম বইমেলাই হবে।
নগরের সিআরবি শিরীষতলায় চলছে অমর একুশে বইমেলা। শুক্রবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) বইমেলা মঞ্চে চসিক প্রদত্ত ‘মহান একুশে স্মারক সম্মাননা ও সাহিত্য পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. হাছান মাহমুদ বইমেলার নাম পরিবর্তন প্রস্তাব সমর্থন করে এর আন্তর্জাতিকীকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
এর আগে এবার নাট্যকলায় চসিক প্রদত্ত মহান একুশে স্মারক সম্মাননা পদক পাওয়া শিশির দত্ত অমর একুশে বইমেলার নাম পরিবর্তন করে ‘চট্টগ্রাম বইমেলা’ হিসেবে ব্রান্ডিং করার প্রস্তাব করেন। এ মেলা একদিন আন্তর্জাতিক বইমেলা হিসেবে গড়ে ওঠবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। এবার ১৬ গুণীজনকে ‘মহান একুশে স্মারক সম্মাননা ও সাহিত্য পুরস্কার’ প্রদান করে চসিক।
অনুষ্ঠানে হাছান মাহমুদ বলেন, শিশির দা যে প্রস্তাব দিয়েছেন আমি তার সঙ্গে একমত। এই মেলার নাম বদলে দিয়ে চট্টগ্রাম বইমেলা করা হোক। এই মেলা আন্তর্জাতিকীকরণ করা প্রয়োজন। বইমেলায় কলকাতার গুণীজনদের ডাকা হবে। আগরতলা, আসামে অনেক বাংলা ভাষাভাষী আছেন তাদেরকে ডাকা হবে। ঢাকা থেকে ডাকা হবে। তাদেরকে সম্মানিত করা হবে। কলকাতা, আগরতলা, আসামসহ তাদের গুণীজন এবং প্রকাশকদেরও যদি আমরা ডেকে আনি তাহলে এই মেলার আন্তর্জাতিকীকরণ হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ইংল্যান্ডে ইংরেজি ভাষায় যখন কোনো বই প্রকাশিত হয়, সেটি একইসাথে নিউইয়র্ক, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডেও হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেটি হয় না। কলকাতায় একটি বই প্রকাশিত হলে সেটি একইসাথে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে একসাথে হয় না। তিনি বলেন, আমরা একই ভাষায় কথা বলি, একই সংস্কৃতি লালন করি, আমরা একই পাখির কলতানে বড় হই এবং একই নদীর অববাহিকায় আমরা বসবাস করি। ৪৭ সালে যে রাজনৈতিক সীমারেখা টানা হয়েছিল সেটা অতিক্রম করে মানুষে মানুষে যে নৈকট্য সেটা আরা বাড়ানো প্রয়োজন। এটা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান উপায় হচ্ছে বই, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি। সুতরাং আগামী বছর থেকে চট্টগ্রাম বইমেলা নামকরণ করে এটার আন্তর্জাতিকীকরণে আমরা প্রয়াস নেব।
তিনি বলেন, মেয়র বলেছেন সিআরবি চত্বর রেখে রাস্তার দুই ধারে এবং যেখানে যেখানে সম্ভব সেখানে বাগান করে দেবেন। এখানে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের আপত্তি থাকার কোনো কারণ দেখি না। প্রয়োজনে আমি নিজেই তাদের সাথে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কথা বলব। হাছান মাহমুদ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করার পর ছাত্রলীগ প্রথম যে ১০ দফা দেয়, সেই ১০ দফার মধ্যে অন্যতম দফা ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে এবং সেই ১০ দফার ভিত্তিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তরুণ নেতা শেখ মুজিবসহ ছাত্র নেতারা জেলায় জেলায় সফর করেছিলেন। এই ইতিহাসগুলো অনুন্মোচিত রয়ে গেছিল, আজকে সেগুলো ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে বাঙালি জাতির মুক্তি নিহিত নেই।
মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে আগামী বছর থেকে চট্টগ্রাম বইমেলা হবে। এটাকে আন্তর্জাতিকীকরণের জন্য পরারাষ্ট্রমন্ত্রী আহ্বান জানিয়েছেন। এটা আমরাও সাদরে গ্রহণ করেছি। আগামী বছর এটাকে আন্তর্জাতিক বইমেলায় পরিণত করা হবে। সহযোগিতা পেলে দেশের বাইরে যারা প্রকাশক আছেন তাদের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করব। এজন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন মেয়র।
মেয়র চট্টগ্রামে খেলার মাঠের সংকট রয়েছে মন্তব্য করে বলেন, শিশু–কিশোরদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। একটা শিশু পার্ক আমাদের খুব প্রয়োজন। শিশু পার্ক করার জন্য একটা মাঠের খুব প্রয়োজন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে মাঠের ব্যবস্থা করে দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে মেয়র বলেন, সিটি কর্পোরেশন নিজস্ব অর্থায়নে শিশু পার্ক করবে। তিনি বলেন, যদি যুব সমাজকে বই এবং সংস্কৃতির নেশায় যদি আকৃষ্ট করতে পারি তাহলে তা তাদের মাদকের নেশা থেকে দূরে সরিয়ে আনবে। চট্টগ্রাম থেকে এ বিপ্লব আমরা শুরু করতে চাই।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। বক্তব্য রাখেন বইমেলার আহ্বায়ক কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু। সম্মাননাপ্রাপ্তদের মধ্যে অনুভূতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন নাট্যকলায় সম্মাননা পাওয়া শিশির দত্ত, কবিতায় সম্মাননা পাওয়া আবসার হাবীব।
এবার চসিক প্রদত্ত একুশে স্মারক সম্মাননা পদক ও সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন– মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনে শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী (মরণোত্তর), শিল্প উন্নয়ন ও সমাজসেবায় মো. নাছির উদ্দিন (মরণোত্তর), চিকিৎসায় প্রফেসর ডা. মো. গোফরানুল হক, নাট্যকলায় শিশির দত্ত, শিক্ষায় প্রফেসর প্রদীপ চক্রবর্তী, সাংবাদিকতায় জসীম চৌধুরী সবুজ, সংবাদপত্র শিল্পের বিকাশ ও মানোন্নয়নে সুপ্রভাত বাংলাদেশ সম্পাদক রুশো মাহমুদ, সঙ্গীতে শ্রেয়সী রায়, ক্রীড়ায় জাকির হোসেন লুলু, চলচিত্র নির্মাণ ও গবেষণায় শৈবাল চৌধুরী, প্রবন্ধ গবেষণায় শামসুল আরেফীন ও ড. শামসুদ্দিন শিশির, কবিতায় আবসার হাবীব ও ভাগ্যধন বড়ুয়া, শিশু সাহিত্যে ছড়াকার অরুণ শীল ও শিবু কান্তি দাশ।
শেষ মুহূর্তে বাদ পড়লেন আসহাব উদ্দিন আহমদ : এর আগে চসিকের প্রকাশিত তালিকায় সংস্থাটির প্রদত্ত ‘মহান একুশে স্মারক সম্মাননা ও সাহিত্য পুরস্কার’ এর তালিকায় ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখায় আসহাব উদ্দিন আহমদ এর নামও অন্তর্ভুক্ত ছিল। পদক গ্রহণ করতে তার স্বজনদের আমন্ত্রণও জানানো হয়। তবে গত বৃহস্পতিবার রাতে এক স্বজনকে ক্ষুদে বার্তা দিয়ে চসিকের পক্ষ থেকে বলা হয়, আসহাব উদ্দিনকে পদক দেওয়া হচ্ছে না, স্থগিত করা হয়েছে।
বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে এর সমালোচনা করা হয়। চসিকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নাম ঘোষণার পর আসহাব উদ্দিন আহমদকে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচক এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। তাই বিতর্ক এড়াতে পদক স্থগিত করা হয়েছে।