‘ব্রেকিং নিউজ! গত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকাসহ চট্টগ্রামে ৩৫টি বাচ্চা নিখোঁজ। সতর্ক থাকুন।’— এমন খবরে সয়লাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। বেশ কয়েকটি বড় বড় ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে এমন স্ট্যাটাস ঘুরপাক খাচ্ছে।
এসব স্ট্যাটাস অনেকেই সত্য ভেবে শেয়ার দিচ্ছেন নিজের প্রোফাইলে। এতে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। চিন্তায় রয়েছেন অভিভাবকরা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একের পর এক শিশু নিখোঁজের ঘটনা ভিত্তিহীন। যারা হারিয়ে গেছে বলে পোস্ট দেওয়া হয়েছিল, পরে তাদের অনেককেই খুঁজে পাওয়া গেছে। আবার পাওয়া গেলেও সেটি আর জানানো হচ্ছে না।
পুলিশ বলছে, সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে গুজবে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। যে বা যারা এসব তথ্য সত্য বলে পোস্ট করছে তাদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শনিবার (৬ জুলাই) দিনভর ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ ও ব্যক্তিগত আইডি থেকে শিশু-কিশোর হারানোর তথ্য ফেসবুকে ভাসতে থাকে। এর বেশিরভাগই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলাকেন্দ্রিক ফেসবুক আইডি থেকে ছড়ানো হয়।
ফেসবুকের তথ্যানুযায়ী— সাইফুল্লাহ সাফা নামে একজন শুক্রবার সন্ধ্যায় তার পোস্টে লেখেন, ‘গত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকাসহ চট্টগ্রামে ৩৫ শিশু নিখোঁজ! সারাদেশে এগুলো কি শুরু হলো হঠাৎ! একটানা এত ছেলে মেয়ে নিখোঁজের সংবাদে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ছেলে ধরার মতো, কোনো একটা সক্রিয় চক্র মাঠে নেমেছে। সবাই সাবধান হন। এ ব্যাপারে প্রশাসন অর্ধমৃত। আপনার সন্তানের নিরাপত্তায় আপনি সচেতন হন। নিউজটি দ্রুত শেয়ার করে সবাইকে অ্যালার্ট করে দিন।’
৩ লাখ ৪১ হাজার ফলোয়ার ‘NTRCA শিক্ষক নিবন্ধন (প্রস্তুতি)’ পেজ থেকে রাতে লেখা হয়েছে, ‘ব্রেকিং নিউজ! গত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকাসহ চট্টগ্রামে ৩৫টি বাচ্চা নিখোঁজ। সতর্ক থাকুন।’
এছাড়াও ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে শিশু হারানোর বিষয়টি ভাইরাল হয়। অনেকে বুঝে না বুঝে এসব তথ্য শেয়ার করা শুরু করেন। এমন তথ্য দেখতে পেয়ে অভিভাবকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
দিনব্যাপী এসব পোস্টগুলোর স্ক্রিনশর্ট থেকে দেখা যায়, কিছু পোস্টে কেবল মাদরাসা ছাত্র নিখোঁজ হচ্ছে, আবার কিছু পোস্টে মুসলিম ছাত্র, কোথাও মেয়েদের কথা বলা হয়েছে। কোথাও স্থান বদলে ঢাকা, চট্টগ্রামের সঙ্গে অন্যান্য জেলার নামও জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
স্ক্রিনশট থেকে প্রাপ্ত পোস্টদাতা বেশ কয়েকজনের সঙ্গে ম্যাসেঞ্জার ও মোবাইল ফোনে কথা বলেছে আজকের বেলা।
হেল্প ইন চট্টগ্রাম নামের একটি গ্রুপে পোস্ট করে এ জে আব্দুল্লাহ নামে একজন লিখেন, ‘আমার ফ্রেন্ডের বোনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । তার নাম উম্মে অবতাহি, বয়স ১৪। দুপুর ১টা ২০ থেকে দেড়টার সময় সি ডি ডি এল স্কুল থেকে বের হয়ে আর বাসায় ফেরেনি। তার পরনে ছিল স্কুলড্রেস। তাকে ওয়াসার গলিতে দেখা গেছে, এরপর আর খোঁজ মিলছে না।’ এই পোস্টটি মুহূর্তে ভাইরাল হতে দেখা যায়।
গ্রুপটিতে মাহেরোজ মুহারিব আফফান নামের আরেকজন পোস্ট করেন, ‘নিজ বাসা থেকে স্কুলে যাওয়ার সময় নিখোঁজ হয় পটিয়ার ১৭ বছর বয়সি মুসতাসরিন চৌধুরী আলিসা।’ দ্রুত সময়ে এই পোস্টটিও ভাইরাল হতে দেখা যায়।
চট্টগ্রাম গ্রুপ নামে একটি পেজে মো. নওশাদ নামে একজন পোস্ট দেন, ‘গত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকাসহ চট্টগ্রামে ৪৮ বাচ্চা নিখোঁজ।’
চিটাগাং ইউনিভার্সিটি নিউজ নামে একটি পেজ থেকে পোস্ট দেয়া হয়, ‘গত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকাসহ চট্টগ্রামে ৩৫ বাচ্চা নিখোঁজ।’
চট্টগ্রাম গ্রুপ নামের পেজে মো. উসামা নামে একজন পোস্টে লিখেন, ‘গত এক সপ্তাহে দেশে ১৫০ এর অধিক মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রী নিখোঁজ।’
৮ জুন সকালে চান্দগাঁও এলাকায় আরাকান সড়কের একটি মাদ্রাসা থেকে নিখোঁজ হয় ৯ বছর বয়সী শাওয়াল শরীফ সাদমান। তার নিখোঁজের বিষয়টি জানাজানি হলে স্বজনরা ফেসবুকে চট্টগ্রাম ভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট করতে থাকেন। এ ঘটনায় আরাফাত উদ্দিন নামের একজন ডেসপারেটলি সিকিং চট্টগ্রাম নামের গ্রুপে পোস্ট করে শিশুটির সন্ধান চান। তবে ওইদিন রাতেই শিশুটিকে পাওয়া গেলেও তিনি সেই তথ্য আর জানাননি।
তবে গুজব থেকে সচেতন হতে সাইদুজ্জামান অন্তর নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী একটি পেজে পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘ফেসবুকে আপনারা অনেকেই নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তির পোস্ট শেয়ার করছেন। যেগুলো শেয়ার করছেন তাদের কয়েকজন ছাড়া বাকি সবাইকে পাওয়া গেছে। নতুন করে দেখা যাচ্ছে অনেকে গ্রুপ বা পেজে শেয়ার করছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৩৫ নাকি কতজন নিখোঁজ, এটা পুরাই ভিত্তিহীন। অহেতুক গুজব ও বিভ্রান্তি ছড়াবেন না। এটা কিন্তু সাইবার ক্রাইম। অনেকে সত্যটা না জেনে এরকম পোস্ট করে জনমনে ভীতি সৃষ্টি করছেন। সবাই এসব পোস্ট রিমুভ করুন।’
এমন নিখোঁজের খবরে আতঙ্কিত হয়ে ফেসবুকে নিজের প্রোফাইলে পোস্ট করেন নাজমা হক নামের এক নারী। তিনি লিখেন, ‘হঠাৎ ছেলে-মেয়ে হারানোর পরিমাণ বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। বিষয়টি শঙ্কার। সবাইকে সাবধানে থাকার অনুরোধ করছি।’
এছাড়াও বেশ কয়েকজন পোস্টদাতারা পোস্ট মুছে ফেললেও স্ক্রিনশটগুলো বিভিন্ন গ্রুপে গ্রুপে ঘুরছে। তারা আসলে কিছুই জানেন না; কে নিখোঁজ হলো, কখন ফিরে আসলো কিছুই বলতে পারেন না তারা।
যারা নিজেদের আত্মীয়-স্বজন বা বোন কিংবা বন্ধুর বোন বলে পোস্ট দিয়েছে তাদের কোনো নিকট আত্মীয় নিখোঁজ হয়নি। আসলে কেউ কেউ বেশ কয়েক ঘণ্টা নিখোঁজ থাকলেও তারা ফিরে এসেছে। ফিরে পাওয়ার বিষয়টি সত্যিকারের আত্মীয় স্বজনরা জানালেও যারা না বুঝে শেয়ার করেছেন তারা আর পরে ফেসবুকে দেওয়া পোস্ট সরাননি। এগুলো ক্রমান্বয়ে ভাইরাল হতে থাকে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার অতনু চক্রবর্তী বলেন, ‘এ ধরনের শিশু নিখোঁজের বহু পোস্ট আমাদের চোখে পড়েছে। তবে বিষয়টি গুজব। কারণ এত শিশু নিখোঁজ হলে থানায় নিশ্চয় অভিযোগ আসতো।’
তিনি বলেন, ফেসবুকে পোস্ট নিশ্চিত না হয়ে বিশ্বাস করবেন না। প্রয়োজনে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ কল করবেন।
জেনে, না জেনে যারা এসব গুজব শেয়ার করছেন তারা জানেনই না অন্যদের ওপর কী প্রভাব পড়ছে। এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে পুলিশ।