সম্প্রতি ছাগলকাণ্ডের মাধ্যমে আলোচনায় আসা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মো. মতিউর রহমান ও তার স্ত্রী-সন্তানদের আটটি ব্যাংক হিসাব ও বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট (বিও হিসাব) স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এ সংক্রান্ত একটি চিঠি শেয়ারবাজারের মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এবং ব্যাংকগুলোতে পাঠিয়েছে বিএফআইইউ। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ক্ষমতাবলে আর্থিক খাতের গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ এ নির্দেশ দিয়েছে।
যাদের ব্যাংক ও বিও হিসাব স্থগিতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে— মো. মতিউর রহমান, তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ, প্রথম স্ত্রীর মেয়ে ফারজানা রহমান (ইপসিতা) ও ছেলে আহাম্মেদ তৌফিকুর রহমান, দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলী, দ্বিতীয় স্ত্রীর মেয়ে ইফতিমা রহমান মাধুরী, দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে ছাগলকাণ্ডে আলোচিত মুশফিকুর রহমান ইফাত ও ইরফানুর রহমান ইরফানের আটটি ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে এসব ব্যাংক হিসাব খোলার ফরম, কেওয়াইসি, লেনদেন বিবরণী ইত্যাদি তথ্য সরবরাহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে মতিউর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিও হিসাব অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করার নির্দেশ দিয়েছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ কমিশন (বিএসইসি)। মঙ্গলবার (২৫ জুন) সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডকে (সিডিবিএল) এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বিএসইসি’র নির্বাহী পরিচালক ও দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম রাইজিংবিডিকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিএসইসি মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের বিও হিসাব অবরুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মতিউর রহমান ঘুষ এবং শেয়ার ব্যবসার মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। এখন পর্যন্ত শুধু প্রাইভেট প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় ২০ কোম্পানিতে মতিউর রহমানের নিজ নাম ছাড়াও স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, বোনসহ কয়েকজন নিকটাত্মীয় এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোম্পানির নামে ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শেয়ার নেওয়ার তথ্য মিলেছে। মতিউর নিজের ও আত্মীয়স্বজনের নামে যে পরিমাণ প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়েছেন, অভিহিত বা প্রকৃত মূল্য হিসাবে এসব শেয়ারের দাম অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা। এর দু’-একটি বাদে সব কোম্পানি আগেই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। তালিকাভুক্তির পর প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় নেওয়া এসব শেয়ার উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে কয়েকশ কোটি টাকা মুনাফা করেছেন মতিউর রহমান।
মতিউর রহমান প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় যেসব শেয়ার পেয়েছেন, তার অনেকগুলোর বিরুদ্ধে আইপিও প্রক্রিয়ায় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে আর্থিক প্রতিবেদনে জালিয়াতি করে মুনাফা বাড়িয়ে দেখানোর অভিযোগ আছে। আর্থিক প্রতিবেদনে জালিয়াতি ঢাকতে এনবিআরে কর ও ভ্যাট দেওয়ার নথিও জাল করার প্রয়োজন পড়ে। যারা জাল-জালিয়াতিতে পূর্ণ আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করেন এবং যেসব কর্মকর্তা এ কাজে সহায়তা করেন, তাদের অধিকাংশই ঘুষের পরিবর্তে শেয়ার নেন। এতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির মালিকপক্ষের নগদে অনেক টাকা বেচে যায়। আবার কোনও বিনিয়োগ ছাড়াই ভুয়া শেয়ার নিয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ শেয়ারবাজার থেকে হাতিয়ে নেন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা। মতিউরের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ রয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে থেকে জানা গেছে, মতিউর প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় যেসব কোম্পানির শেয়ার নিয়েছেন, সেগুলো হলো– এক্মি পেসটিসাইডস (৩৮ লাখ শেয়ার), অনিক ট্রিমস (৫৩.১৯ লাখ), অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন (১০ লাখ), বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার (৭৫ হাজার), সিএনএটেক্স (১০.৩০ লাখ), ডমিনেজ স্টিল (১৫.৮০ লাখ), ই-জেনারেশন (৫০ হাজার), ফরচুন সুজ (৪৩.১০ লাখ), কাট্টলী টেক্সটাইল (২১ লাখ), ল্যুবরেফ (৮ লাখ), মামুন এগ্রো (৩৭.৮৭ লাখ), এমএল ডাইং (১৬ লাখ), রিং সাইন (১০ লাখ), এসকে ট্রিমস (৯০ লাখ), টেকনো ড্রাগস (১.৫০ লাখ), ওয়েব কোস্টস (১৩.৯৭ লাখ) শেয়ার। প্যাসিফিক ডেনিম এবং সিলভা ফার্মারও কিছু শেয়ার আছে। এর মধ্যে এসকে ট্রিমস কোম্পানি নিজেই গড়েছেন মতিউর। তবে, এর বাইরেও তার নামে আরও শেয়ার থাকতে পারে বলে জানা গেছে।
ছাগলকাণ্ডের পর মতিউর রহমানকে কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে প্রত্যাহার করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকেও অপসারণ করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে তদন্ত টিম গঠন করেছে।
উল্লেখ্য, ঈদুল আজহার আগে ঢাকার সাদিক অ্যাগ্রো থেকে ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কিনতে গিয়ে আলোচনার জন্ম দেন মতিউর রহমানের ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত। তবে, শুরুতে ইফাতকে ছেলে হিসেবে অস্বীকার করেন মতিউর রহমান। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা ও খবর প্রকাশিত হতে থাকে। মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে রিসোর্ট, শুটিং স্পট, বাংলো, জমিসহ নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির বিষয়ে গণমাধ্যমের খবরে আলোচনা শুরু হয়।