আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠনে অন্যতম দাবিদার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। চলতি বছরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বৈঠক, সংলাপ ও মাঠপর্যায়ের বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছেন দলটির নেতারা।
সবশেষ গত সোমবার বিএনপির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকেও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে সরকারের চেষ্টার কথা জানিয়েছেন।
সার্বিক পরিস্থিতিতে আগামী ডিসেম্বরকে নির্বাচন আয়োজনে সম্ভাব্য সময় ধরে সারা দেশে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোটের আমেজ ছড়াতে সক্রিয় হয়েছে বিএনপি। দলটি চলতি মাসে দেশের ৬৭টি সাংগঠনিক জেলায় সমাবেশের ঘোষণা করেছে। এসব কর্মসূচির পাশাপাশি আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জে কৃষক মহাসমাবেশ করবে বিএনপি। তাতে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জেলায় জেলায় সমাবেশের মধ্য দিয়ে বিএনপির নির্বাচনী ট্রেনের যাত্রা শুরু হচ্ছে আজ বুধবার। নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রচার-প্রচারণা আর দল গুছিয়ে নেওয়ার এমন তৎপরতায় বিএনপির সামনে বলতে গেলে পুরো মাঠ ফাঁকা।
গত বছর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং আওয়ামী লীগের ছন্নছাড়া অবস্থায় শহীদ জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দলটির এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে একক আধিপত্য। জামায়াতে ইসলামীও দেশব্যাপী সংগঠন গোছানোর কাজে ব্যস্ত। তবে বিএনপির এমন বড় কলেবরের আয়োজনের তুলনায় তা অনেকটাই কম।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা, অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, দ্রুত গণতান্ত্রিক উত্তরণে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা, পতিত ফ্যাসিবাদের দোসরদের নানামুখী চক্রান্তের অপচেষ্টা মোকাবিলাসহ বিভিন্ন দাবিতে দেশব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করছে বিএনপি। এসব সমাবেশে যোগ দেবেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যবৃন্দ, ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিবসহ দলটির অন্যান্য সিনিয়র নেতা।
কর্মসূচি সফল করতে বিভাগীয় সাংগঠনিক, সহসাংগঠনিক এবং সংশ্লিষ্ট জেলার কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জেলা পর্যায়ে সমাবেশের পর মহানগর ও বিভাগীয় সদরে বিএনপি সমাবেশ করবে বলে জানা গেছে।
বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, সারা দেশে নির্বাচনের আমেজ ছড়িয়ে দিতে জেলায় জেলায় কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। জনদাবির ব্যানারে এসব কর্মসূচির আয়োজন হলেও নির্বাচন সামনে রেখে জনগণের আরও কাছে যাওয়ার ওপর জোর দেওয়া হবে। দ্রুত অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা হবে। এর মধ্য দিয়ে গ্রাম-গঞ্জে নির্বাচনী বাতাস বইতে শুরু করবে। দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা ভোটারদের কাছে যাবেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করবেন।
সমাবেশগুলো থেকে ভোটারদের কাছে আগামী নির্বাচনে দলের সম্ভব প্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেবে বিএনপি। পাশাপাশি দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে মাঠপর্যায়ে সম্ভাব্য প্রার্থীদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হবে। ভোটারের আস্থা অর্জনে নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে। দেশ নিয়ে বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরবেন নেতারা। সেসব পরিকল্পনা নিয়ে জনগণের কাছে যাবেন দলীয় নেতাকর্মীরা।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, ‘বিএনপি বারবার বলে আসছে যে একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন হওয়া দরকার। নির্বাচনের জন্য বিএনপির অবশ্যই প্রস্তুতি রয়েছে। বিএনপি একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী দল। ৩০০ সংসদীয় আসনের প্রতিটিতে একাধিক নেতা প্রার্থী হওয়ার জন্য প্রস্তুত। তাদের সবাই যোগ্য। নির্বাচনের প্রস্তুতির কোনো সমস্যা নেই।’
জেলা পর্যায়ে সমাবেশ আয়োজন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ও নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে এসব সমাবেশ হচ্ছে। এটা রাজনৈতিক প্রোগ্রাম, সাংগঠনিক প্রোগ্রাম। এটা চলমান প্রক্রিয়া। এই কর্মসূচি শেষ হলে সামনে আরও কর্মসূচি আসবে।’
চলতি বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি থাকলেও বিএনপি মনে করছে জুলাই-আগস্টে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। নির্বাচন হলে দেশের চলমান সংকট দ্রুত দূর হয়ে যাবে বলে মনে করছে দলটি। বলছে নির্বাচন হলে একটি নির্বাচনী সরকার আসবে। একটি শক্তিশালী পার্লামেন্ট থাকবে। সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে। সরকারে জনগণের ম্যান্ডেট থাকবে। সরকারের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক থাকবে। ফলে অনেক সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। শহীদ জিয়ার এই দল সব সময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত থাকবে।’
গত সোমবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। বৈঠক শেষে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে অতিদ্রুত তারা নির্বাচনের ব্যবস্থা করছেন। তিনি (উপদেষ্টা) বলেছেন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করার জন্য তারা কাজ করছেন। আমরা আশা করব অতিদ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন তিনি। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি। জনগণেরও একই প্রত্যাশা।’
দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার প্রেক্ষাপটে গত শনিবার থেকে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু করেছে সরকার। এই অভিযান সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেছেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারপ্রধানকে বলেছি যে এ ধরনের অভিযান আগেও হয়েছে। তবে কোনোভাবেই ইনোসেন্ট কোনো মানুষ যেন আক্রান্ত না হয়। এ বিষয়ে যেন কোনো সমস্যা তৈরি না হয়।’
গত শনিবার কুমিল্লার দাউদকান্দিতে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। বিএনপি ৩০০ আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। তাই যেকোনো সময় নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষণা করা হোক।’
জেলা পর্যায়ে সমাবেশ শুরু আজ
আজ বুধবার দেশের ছয় জেলায় সমাবেশের আয়োজন করছে বিএনপি। এর মধ্যে লালমনিরহাটের সমাবেশে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সিরাজগঞ্জে নজরুল ইসলাম খান, খুলনায় মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, পটুয়াখালীতে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল এবং সুনামগঞ্জে আরিফুল হক চৌধুরী প্রধান অতিথি থাকবেন।
এরপর ১৬ ফেব্রুয়ারি: ফেনীতে অনুষ্ঠেয় সমাবেশে প্রধান অতিথি থাকবেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
১৭ ফেব্রুয়ারি: যশোরে সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একই দিন টাঙ্গাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান, কক্সবাজারে সালাহউদ্দিন আহমেদ, মাদারীপুরে সেলিমা রহমান, চাঁদপুরে ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, ঠাকুরগাঁওয়ে শামসুজ্জামান দুদু, বগুড়ায় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম, শরীয়তপুরে ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, মৌলভীবাজারে আরিফুল হক চৌধুরী, ভোলায় জহির উদ্দিন স্বপন এবং নেত্রকোণায় সমাবেশে যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেবেন।
১৮ ফেব্রুয়ারি: মানিকগঞ্জের সমাবেশে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, পাবনায় ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, পঞ্চগড়ে ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, কুমিল্লা দক্ষিণে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদীন ফারুক, ঝিনাইদহে আবুল খায়ের ভূঁইয়া, হবিগঞ্জে যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি এবং সৈয়দপুরে সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স প্রধান অতিথি থাকবেন।
১৯ ফেব্রুয়ারি: নোয়াখালীতে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, রাজবাড়ীতে ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন, কুষ্টিয়ায় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু, কিশোরগঞ্জে ফজলুর রহমান, সিলেটে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, পিরোজপুরে মজিবর রহমান সরোয়ার ও জামালপুরে মো. জহুরুল হক শাহাজাদা মিয়া।
২০ ফেব্রুয়ারি: ঢাকায় প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, লক্ষ্মীপুরে স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বরিশাল দক্ষিণে সেলিমা রহমান, ফরিদপুরে ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন, চুয়াডাঙ্গায় আমানউল্লাহ আমান, নওগাঁয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু, কুড়িগ্রামে আবদুস সালাম এবং ময়মনসিংহ দক্ষিণে আবদুল আউয়াল মিন্টু।
২২ ফেব্রুয়ারি: ঝালকাঠিতে প্রধান অতিথি থাকবেন ভাইস চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন, চট্টগ্রাম দক্ষিণে আহমদ আযম খান, ময়মনসিংহ উত্তরে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান, গোপালগঞ্জে ড. আসাদুজ্জামান রিপন, রংপুরে আবুল খায়ের ভূঁইয়া, জয়পুরহাটে হারুন অর রশিদ, কুমিল্লা উত্তরে মাহবুব উদ্দিন খোকন, বান্দরবানে যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন-নবী খান সোহেল এবং নরসিংদীতে আবদুস সালাম আজাদ।
২৪ ফেব্রুয়ারি: মুন্সীগঞ্জে প্রধান অতিথি থাকবেন স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বরিশাল উত্তরে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, নাটোরে ভাইস চেয়ারম্যান আহমদ আযম খান, নড়াইলে নিতাই রায় চৌধুরী, গাইবান্ধায় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হারুন অর রশিদ, রাজশাহীতে অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান, রাঙামাটিতে যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন-নবী-খান সোহেল এবং মাগুরায় আবদুস সালাম আজাদ।
২৫ ফেব্রুয়ারি: নারায়ণগঞ্জে সমাবেশে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গাজীপুরে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, চট্টগ্রাম উত্তরে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সাতক্ষীরায় ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী, বাগেরহাটে বরকত উল্লাহ বুলু, খাগড়াছড়িতে উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরী, মেহেরপুরে আমানউল্লাহ আমান, নীলফামারীতে জয়নুল আবদীন ফারুক, চাঁপাইনবাবগঞ্জে আবদুস সালাম এবং দিনাজপুরের সমাবেশে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেবেন।